মিড-ডে, মিল নেই!
স্যারের আস্তে দেরি হচ্ছে দেখে আমরা বেশ চিৎকার করে করে গল্প করছিলাম। আমার আগের বেঞ্চে বসে থাকা আমার বন্ধু রাজু জিজ্ঞেস করল; আজ কি তুই স্কুলে খাবি? আমি হ্যাঁ বলতেই রাজু খুশি হয়ে বলল তাহলে আজ আমিও খাব।
রাজু স্কুলে দেওয়া মিড-ডে-মিলের কথা বলছিল। আমার ঘরটা স্কুল থেকে খুব একটা দূর নয়, টিফিনের সময় ইচ্ছে করলেই আমি ঘরে খেয়ে আসতে পারি, কিন্তু স্কুলে সব বন্ধুদের সাথে বসে খেতে আমার খুব ভালো লাগে; ঠিক যেন একটা ছোটোখাটো পিকনিক। সেজন্যই আমি, নাড়ু, পিন্টু প্রায় প্রতিদিনই দুপুরের খাবার স্কুলেই খাই।
একটু পরে স্যার ক্লাসে ঢুকলেন। আমরা সবাই দাঁড়িয়ে একসুরে বললাম – “গুড মর্নিং স্যার …”। স্যারও আমাদের গুড মর্নিং বলে, বসতে বললেন। চেয়ার টেনে বসে জিজ্ঞেস করলেন, আগের দিন কতদূর পড়া হয়েছিল?ফার্স্ট বেঞ্চের আকাশ দাঁড়িয়ে বলল, স্যার <আমার বই> -এর ১৬ পাতা পর্যন্ত।স্যার পড়াতে শুরু করলেন, আগের দিন আমার দেখেছি...…
অন্যদিন স্যার পড়া শুরু করার আগে আমাদের বললেন, আজ স্কুলে এই এই তরকারি হয়েছে; কে কে খাবি হাত তোল? এটা রোজকার রুটিন, কিন্তু আজ তো জিজ্ঞেস করলেন না! হয়তো ভুলে গেছেন, মনে মনে ভাবলাম।যাইহোক আবার স্যারের পড়ানোয় মন দেওয়ার চেষ্টা করলাম।
দেখলাম রাজু ঝুঁকে ঝুঁকে বাইরে কি যেন দেখার চেষ্টা করছে। আমি পেছন থেকে ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, এই রাজু, কি হল তোর? হিসি লেগেছে নাকি?রাজু ঘাড় ঘুরিয়ে জোরে বলে উঠল, ধুস!স্যার সামনে থেকে বকা দিয়ে উঠলেন, কে চিৎকার করছে!রাজু থমকে গেল। আবার একটু পরে ঘাড় ঘুরিয়ে ফিস ফিস করে বলল, বড় বাঁচা বেঁচে গেলাম।ভাবছিলাম আজকে কি সবজি রান্না হয়েছে, স্যার যে বললেন না! তাই রান্না ঘরে কি হচ্ছে দেখার চেষ্টা করছিলাম।
আমি বললাম, স্যার হয়তো আজ বলতে ভুলে গেছেন।রাজু একটু ভেবে, হু হবে হয়তো, বলে ঘাড় ঘুরিয়ে নিল।
কিছুক্ষণ পর, স্যার পড়া শেষ করে বেরিয়ে যেতেই, হেড স্যার ক্লাসে ঢুকে দুঃসংবাদ দিলেন; আজ স্কুলে রান্না হয়নি, জ্বালানি শেষ হয়ে গেছে, জ্বালানি কাল আসবে, তখন আবার রোজকার মত মিড-ডে-মিল দেওয়া হবে।
রাজুর মাথায় যেন বজ্রপাত হল। ইস! আজ ভাবলাম স্কুলে খাবো; এবার খেতে বাড়ি যেতে হবে!
(২)বাড়ি থেকে খাবার খেয়ে দৌড়ে তাড়াতাড়ি স্কুলে ফিরে এলাম। এসে দেখি, ক্লাস রুম ফাঁকা। আমি ভেবেছিলাম রাজু আগেই চলে এসেছে। যাইহোক কেও যখন আসেনি, আমি আর ক্লাসে একা বসে থেকে কি করব, যাই সামনের বট গাছের নিচের ধারিটাই গিয়ে বসি। ক্লাস থেকে বেরোতে যাবো তখন হঠাৎ চোখে পড়ল একেবারে শেষের বেঞ্চের ডেস্কে মাথা রেখে কে যেন বসে আছে।
দু'পা বাড়াতেই বুঝতে পারলাম, কাঞ্চন। হয়তো বাড়ি থেকে এসে কাওকে না পেয়ে, এক ঘুম ঘুমিয়ে নিচ্ছে।
ওকে ঠেলা দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কিরে ঘুমিয়ে পড়লি নাকি!
কাঞ্চন, মাথা তুলে শুকনো হাসি মুখে বলল, না না এমনি...
কাঞ্চন মুখ চোখ একেবারে শুকনো। চোখগুলো একেবারে যেন ঢুকে গেছে। জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে? শরীর খারাপ?
না না, শরীর ঠিক আছে। আসলে সকাল থেকে কিছু খাইনি তো...
খাসনি কেন? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
রোজ তো দুপুরে স্কুলে খাই, তাই সকালে খেয়ে আসিনা।
টিফিনে বাড়িতে খেতে গেলিনা কেন?
রান্না করবে কে!
কেন, তোর মা?
আমি স্কুল চলে আসার পরই তো মা-বাবা ইট ভাটায় কাজে চলে যায়, আসে সেই সন্ধ্যায়।
দোকানে কিছু কিনে...
আমাকে শেষ করতে না দিয়েই কাঞ্চন আবার ডেস্কে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল।
বেচারার খুব খিদে পেয়েছে মনে হয়। তখনই মনে পড়ল, আমার পকেটে তো কুড়ি টাকা আছে, মা সকালে দিয়ে,বলেছিল, মন হলে কিছু কিনে খেতে।
তাড়াতাড়ি পাশের দোকানটায় গিয়ে এক প্যাকেট বিস্কুট কিনে আনলাম। ক্লাসে এসে কাঞ্চনকে আবার ঠেলা দিলাম, সে মাথা না তুলেই বলল, যা যা বিরক্ত করসি না আমাকে।
আমি আরেকবার তাকে ঠেলা দিলাম, কাঞ্চন...এই কাঞ্চন দেখ তোর জন্য বিস্কুট কিনে এনেছি। মাথা তুলে ক্লান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, না না আমি খাবো না, খিদে নেই।
বুঝলাম ও এমনিতে নেবে না। তখনই দৌড়ে রাজু ক্লাসে ঢুকল, আমাকে দেখে বলল চল বাইরে চল, সবাই লুকোচুরি খেলছে।
আমি ওকে ইশারা করে ডাকলাম। ঘটনাটা ওকে খুলে বললাম। কিছুক্ষন গম্ভীর মুখে ভেবে, বলল আমার মাথায় একটা প্ল্যান আছে, আমি যা যা করছি, তার মতো করে এক্টিং কর।
রাজু এবার দরজার পাশে গিয়ে প্যাকেটটা ছিঁড়ে জোরে জোরে বলল ―উফঃ এতগুলো বিস্কুট খাওয়া ঠিক হলো, এখনও অনেক গুলো বাকি, কাকে যে দিই। আকাশ, এই আকাশ বিস্কুট খাবি?
আমিও ওর সাথে তাল মিলিয়ে জোরে জোরে বললাম, না রে আজ ঘরে একটু বেশিই ভাত খেয়ে ফেলেছি। খুব জোর হলে একটা বিস্কুট খেতে পারি।
রাজু এবার কাঞ্চনের কাছে গিয়ে বলল, এই কাঞ্চন একটা, বিস্কুট খাবি, আমরা আর কেও খেতে পারছি না!
কাঞ্চন, এবার মাথা তুলে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল, খেতে পারবি না তো কিনেছিস কেন?
রাজু কিছু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল, আমতা আমতা করে বলছিল, মানে ইয়ে এই...
আমি কাঞ্চনকে বললাম, রাজু ভুল করে ফেলেছে, আর করবে না, এইবারের মত উদ্ধার করে, রাজুর বাবা জানতে পারে, খুব বকা দেবে ওকে।
কাঞ্চন, একটু চুপ থেকে বলল, ঠিক আছে।
রাজু বিস্কুটের প্যাকেটটা ওর হাতে দিল। ও গব গব করে সবগুলো এক নিঃস্বাসে খেয়ে ফেলল।
ভালো করেই জানি, চার-পাঁচটা বিস্কুট খেয়ে ওর খিদে মিটবে না। কিন্তু আমাদের হাতে তো আর কিছু নেই!
বিস্কুট গুলো খেয়ে ওর চোখে মুখে যেন প্রাণ ফিরে এলে।
আমরাও স্বস্তির নিঃস্বাস ফেললাম।
স্কুল ছুটি হয়ে বাড়িতে ফিরে এসে মা-বাবা কে ঘটনা খুলে বললাম। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, খুব ভালো কাজ করেছো, সত্যিকারের মানুষের মত কাজ করেছো।
বাবা মাকে বলল, কাল থেকে ওকে পঞ্চাশ টাকা করে দিও; আজকের মতো কোনো দিনের জন্য...
মা আমাকে বলল, এক কাজ করিস তো, কাঞ্চনকে এই রবিবার আমাদের ঘরে খাওয়ার নিমন্ত্রণ করিস।
আমি উৎসাহের সাথে বললাম, আমি কালকে গিয়েই ওকে বলব।